” সমাজের কল্যানে মানুষ নামক ব্যক্তিটির ব্যক্তিত্ব, যে উপায়ে সম্যকরূপে বিকশিত হয় তাহার নামই শিক্ষা “—- বনফুল।
অর্থাৎ মনুষ্যত্বের বিকাশে অন্যতম পন্থা হলো শিক্ষালাভ। একজন মানুষের পাশবিক প্রবৃত্তি দূর করে তাকে সামাজিকভাবে দায়িত্বশীল নাগরিক হিসাবে গড়ে তোলে শিক্ষা। এই শিক্ষালাভের প্রাথমিক পর্যায় হলো অক্ষর পরিচিতি যেটি ছাড়া মানুষ চোখ থাকতেও অন্ধ। শৈশব থেকেই মানুষ অক্ষরের সাথে পরিচিতি লাভ করে, অর্থাৎ শৈশবকালই হলো শিক্ষার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের উপযুক্ত সময়। একজন শিশুকে শিক্ষাদানের অর্থ হলো সমাজের সার্বিক কল্যাণের একটি বীজবপন করা।
শিক্ষালাভ প্রত্যেকটি শিশুরই জন্মগত অধিকার। কিন্তু অনেক সময়েই দেখা যায় এই অধিকারের পথে বাঁধ সাধে আর্থিক ও পারিবারিক সমস্যা। যার ফলে বহুক্ষেত্রেই এই সব শিশুদের শিক্ষালাভের পথকে দূরে সরিয়ে বেছে নিতে হয় কর্মজীবনের পথ। ফলস্বরূপ এই সব শিশুদের মনস্তাত্ত্বিক বিকাশটি অসম্পূর্ণ থেকে যায়। জীবনের স্বাভাবিক ছন্দ হারিয়ে ফেলে এই শিশুরা। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে আমরা অনেক সময়েই বহু শিশুশ্রমিককে দেখে থাকি যারা তাদের অর্থনৈতিক সমস্যা সমাধানের জন্য জীবিকা নির্বাহের পথ বেছে নিয়েছে। এবং কর্মক্ষেত্রের উর্ধস্তন ব্যক্তিরা নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য এদের ক্রমাগত ঠকিয়ে চলেছে এবং ব্যবহার করে চলেছে। বঞ্চিত করে চলেছে এদের ব্যক্তিগত অধিকার থেকে। এই সমস্ত শিশুরা ঘুনাক্ষরেও সেসব টের পায়না কারণ তাদের নিরক্ষরতা ও অজ্ঞতা। একমাত্র শিক্ষাদানের মাধ্যমেই সম্ভব এই শিশুদের সামাজিক গ্লানি থেকে মুক্ত করে জীবনের আলোকে ফিরিয়ে আনা। একমাত্র অক্ষর পরিচিতিই পারে এই শিশুদের আগামী জীবনের জন্য মহীরুহ হিসাবে গড়ে তুলতে।
বর্তমান সমাজে শিক্ষালাভের বিষয়টি ধনতান্ত্রিক হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে আজকের অনলাইন শিক্ষালাভের যুগে দেখা যায় মফস্বলের বিদ্যালয়গুলিতে পরিকাঠামোর অভাব। অধিকাংশ শিক্ষার্থীদের অর্থনৈতিক অসমর্থতা তাদের ব্যক্তিগতভাবে পরিকাঠামো উন্নয়নেও বাধাপ্রদান করছে। যার ফলে ইচ্ছা সত্ত্বেও শিক্ষাবিমুখ হয়ে পড়ছে এক বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থী। এই বিমুখতার প্রভাবে ধীরে ধীরে তারা হারিয়ে ফেলছে উৎসাহ। বেছে নিচ্ছে জীবিকা নির্বাহের পথ। বিদ্যালয়গুলিও ধীরে ধীরে বিদ্যার্থীশূন্য হয়ে পড়ছে। এই ভাবেই জীবনধারনের বিচারে পিছিয়ে পড়ছে মফস্বলের শিশুরা শহরাঞ্চলের নামি বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করা শিশুদের তুলনায়। গ্রামাঞ্চলের একটি প্রজন্ম এইভাবে অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে পড়ছে যা সমাজের সার্বিক উন্নতির জন্য খুব একটা ভালো সংকেত না। এমত অবস্থায় গড়ে উঠেছে আমাদের এই স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ” তরী ওয়েলফেয়ার সোসাইটি “, যার মূল লক্ষ্য হলো এই বিমুখ পথযাত্রী শিশুদের শিক্ষার আলোকে ফিরিয়ে আনা। অন্তত অক্ষরগুলি পরিচয় করিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে তাদের জ্ঞানচক্ষুটি উন্মোচিত করে দেওয়া।
অতিমারী পরিস্থিতিতে আমাদের রাজ্যের সমগ্র শিক্ষা ব্যবস্থা কার্যত বিকল হয়ে পড়েছিল। এখন পরিস্থিতি খানিকটা সহজ হলেও দীর্ঘ দু বছরে পঠনপাঠন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে বহু পড়ুয়া। এবং আরো অনেক পড়ুয়ার ক্ষেত্রে দীর্ঘ অনভ্যাসের ফলে পড়াশোনার ক্ষেত্রে বিভিন্ন সমস্যা দেখা দিয়েছে। এই প্রসঙ্গে সব থেকে বেশি প্রভাবিত প্রাথমিক স্তরের ছাত্রছাত্রীরা। তাদের সমস্যার আংশিক সমাধানের জন্য ” তরী ওয়েলফেয়ার সোসাইটি ” উদ্যোগ নিয়েছে একটি প্রাথমিক শিক্ষা কেন্দ্রের। মূলত প্রাথমিক শিক্ষার্থীদের জন্যই আমাদের এই উদ্যোগ। এখানে প্রতি সপ্তায় দুদিন আমাদের সদস্যরা নিয়মিত কিছু ছাত্রছাত্রীকে তাদের পড়াশোনায় সাহায্য করেন। সুস্থ সমাজ গঠনের মূলমন্ত্র শিক্ষা। শিক্ষাই শক্তি এবং শিক্ষাই ভবিষ্যত নির্মাণের আধার —- এই ভাবনাকে মাথায় রেখেই আমাদের এই ক্ষুদ্র প্রয়াস ” কিশলয় “।